মুসা আল হাফিজ :
পশ্চিমা চিন্তাবিদদের অনেকেই ইসলামী দর্শনকে অস্বীকার করে বসেছেন। তারা বলছেন, এ হচ্ছে গ্রিক দর্শনের সন্তান। বহিরাগত বিষয়। গ্রিক আত্মার সাথে বিভিন্ন জাতির চিন্তার সমষ্টি। আলফ্রেড গুইম তার হিস্টরি অব ফিলোসফি ইন ইসলাম গ্রন্থে স্পষ্ট বলেছেন, গ্রিক ভাষা থেকে অনূদিত গ্রন্থাবলির ওপর ভর করেই মুসলিম দর্শন যাত্রা শুরু করে। আর তার প্রকৃতি ছিল কেবল সংগ্রহ করে যাওয়া। তিনি তাই ইসলামের দর্শনকে যাচ্ছেতাই প্রতিপন্ন করেছেন। বলেছেন, এটি কোনো যথার্থ দর্শন নয়, কারণ চিন্তার অগ্রগতিতে তার কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান নেই। ফ্রান্সের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আরনেস্ট রেনান বলেন, ‘এই দর্শন অ্যারিস্টটলের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া কিছুই নয়। এতে শুধু গ্রিক চিন্তভাবনাকেই আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে।’
রেনান কিংবা গিয়োম এ সত্য অস্বীকার করতে পারেননি যে, পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্যতা নেই, যারা অগ্রযাত্রার ক্রমধারায় পূর্ববর্তী সভ্যতার নানা উপাদানকে কাজে লাগায়নি। তারা এ প্রশ্নের জবাব দেননি যে, সব সভ্যতা যখন গ্রহণ-বর্জনের ধারায় এগিয়েছে, তখন মুসলিম সভ্যতা এর থেকে ব্যতিক্রম হবে কেন?
গ্রিক অনুবাদ মুসলমানরা যখন করেন, তার আগেই ইসলামী দর্শন আপন অবয়বে সুস্পষ্ট। গ্রিক দর্শন যখন মুসলিম দুনিয়ায় আসে, তখন ইসলামী দর্শন সাত শত এর মতো বিষয়ে আলোচনা করে চলেছে। কিন্তু তখন গ্রিক দর্শনের আলোচ্য দিক ছিল সর্বসাকুল্যে দুইশ’র মতো। ইসলামী ধর্মতত্ত্বের এমন কোনো দিক ছিল না, যার জন্য অন্য সভ্যতার উপাদান লাগবে। ইসলাম আপন জ্ঞানতত্ত্ব, জ্ঞানকাণ্ড ও জ্ঞানকর্মের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল আপন শক্তিতেই। এরই মধ্যে মুসলিম সভ্যতার বিশ্বজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে।
আব্বাসী আমলে মুসলিম খেলাফত অন্যান্য জাতির বিলুপ্তপ্রায় জ্ঞান উদ্ধারের প্রয়াস হাতে নেয়। বিশ্বরাজধানী বাগদাদে দুনিয়ার নানাপ্রান্তে ছড়ানো জ্ঞান একত্রিত করার উদ্যোগ নেয়। এ ছিল মানবসভ্যতার প্রতি অনুগ্রহ। যদি কাজটি না হতো, ইসলামপূর্ব দুনিয়ার অধিকাংশ জ্ঞান বিপন্ন হতে পারত। বিশেষত গ্রিক দর্শন নিশ্চিহ্ন হবার ভয় ছিল বাস্তব। যখন অন্ধকার ইউরোপে চলছিল শিক্ষার বিরুদ্ধে যাজকতন্ত্রের আন্দোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছিল ধ্বংস, দর্শনকে করা হয়েছিল নিষিদ্ধ, দার্শনিকদের করা হচ্ছিল হত্যা।
মুসলিমরা গ্রিক গ্রন্থাবলির অনুবাদ করেছেন ইসলামের প্রয়োজনে নয় মোটেও। সব কালের জ্ঞানের প্রতি অনুরাগের জায়গা থেকে। যে অনুরাগ পেয়েছেন ইসলামের শিক্ষা থেকে। মুসলিম উলামার কাছে এসব জ্ঞান ছিল একান্ত গৌণ। একারণে এসব অনুবাদ প্রধানত অমুসলিম অনুবাদকদের দিয়ে করানো হয়। প্রাথমিক অনুবাদের পরে এর পেছনে মেধা বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন মুসলিম চিন্তকদের একটি অংশ। অনুবাদ এক অর্থে আমদানি, আবার কখনো রক্ষাও। কী আমদানি? তথ্য, তত্ত্ব, প্রকরণ, ভাব। ব্যাস। গ্রন্থ মানে মেধা নয়। এই গ্রন্থগুলো পশ্চিমা দেশগুলোতে বহু শতাব্দী ধরে ছিল। কিন্তু মেধা ছিল না সেখানে। ইউরোপে এসেছিল অন্ধকার যুগ। অতএব মুসলিমদের মেধা বিনিয়োগ ও মনোযোগ প্রদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা এসব বই সম্পাদনা করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন, সারসংক্ষেপ করেছেন। এগুলোকে দিয়েছেন নবজীবন। এগুলোকে গ্রহণ করেননি অন্ধভাবে। কারণ মুসলিম সভ্যতার কাঠামো ও জ্ঞানভাণ্ডার নিজস্ব চরিত্রে সুগঠিত। ইসলামের বিশ্বাস ও জ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে এগুলোর যাচাই-বাছাই করেছেন।
ইসলামের বিচারে এর কী কী গ্রহণীয়, সেসব নিয়ে ছিল বিতর্ক। আল কিন্দি, আল ফারাবি, ইবনে সিনারা চেয়েছিলেন ইসলামের বিচারে প্রত্যাখ্যাত ও অস্বস্তিকরের অনেক কিছুকে ইসলামের সাথে মিলিয়ে নিতে। এ কাজে তারা নানামুখী ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন ইসলামের জায়গা থেকে। ফলে মুসলিম জ্ঞানদৃষ্টি তাদেরকে আক্রমণ করেছে। এমনকি তারা বরং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অন্য জাতির চৈন্তিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণে ইসলাম বরাবরই সাবধানতা আরোপ করে। যেখানে ইসলাম নিজেই চিন্তা, দর্শন ও সংস্কৃতির স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তক।
ইসলামের সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে যেন উত্ত্যক্ত না করে, এজন্যে গ্রিক দর্শন ও এর প্রতি অনুরাগীদের তীব্র-কঠোর সমালোচনা করেছে ইলমে কালাম।
যারা গ্রিক দর্শন চর্চা করেছেন, তারা এর মধ্যকার দু’শটি বিষয়ের ওপর চালিয়েছেন প্রবল কাঁচি। কেননা এগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি অংশকে মুসলিম দার্শনিকরা সংশোধন করেছেন। আরেকটি অংশকে ইসলামী চিন্তার আলোকে ব্যাখ্যা করে নতুন অবয়ব দিয়েছেন। তৃতীয় অংশটিতে আরো নতুন নতুন যুক্তি ও প্রমাণ সংযোজন করা হয়েছে। এর মানে পরিষ্কার। গ্রিক দর্শন মুসলিম দুনিয়ায় এসে মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনার হাতে নিরীক্ষণের সম্মুখীন হয়। তাদের সৃজনশীলতার হাতে বিচার-বিশ্লেষণের এমন অধ্যায়ে প্রবেশ করে, যেখানে সে বলতে গেলে লাভ করে এক মুসলিম অবয়ব। নিজেদের শক্তিশালী দার্শনিক ঐতিহ্যের কারণে একে তারা জাতীয় রূপ দিয়ে পাশে জায়গা দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও শেষ অবধি তার জায়গা হচ্ছিল না প্রথম অংশের ভুলের কারণে। মুসলিম দার্শনিকরা সেগুলোকে সংশোধন করলেও ভুল থেকে গিয়েছিল। কারণ গ্রিক দর্শনের শেষ সীমা মানুষের স্বজ্ঞা। সে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা দিয়ে বিচার করে, সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইসলামে জ্ঞানের উৎস আরো উপরে, যুক্তি, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা,স্বজ্ঞার পরে ইলহাম ও সরাসরি ওহি থেকে তার আগমন। অতএব ইসলামী দর্শন যা দেখে, গ্রিক বা আধুনিক পশ্চিমা দর্শন তার অনেক কিছুই দেখে না। দেখার সামর্থ্য নেই।
ফলে প্রায় প্রত্যেক মুসলিম দার্শনিকের চিন্তার স্বকীয়তা ছিল ইসলাম অভিমুখী। এমনকি কিন্দি-ফারাবিরাও গ্রিক দর্শনকে নিজস্ব বিশ্বাস ও বিভূতির ছাপে ফেলে বিশ্লেষণ করেছেন। তারাই গ্রিক দর্শনের সবচে বড় প্রচারক। কিন্দি কেবল অনুবাদক ছিলেন না, তাকে মানা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফির জনক। আবিষ্কার করেন কয়েকটি নতুন গাণিতিক পদ্ধতি। যার মধ্যে কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতি অন্যতম। গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করে তিনি ওষুধের কার্যকারিতা পরিমাপক যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এরিস্টটলের মেটাফিজিকস বা তত্ত্বকথার আরবি অনুবাদ করছিলেন তিনি। বিশ্বজগতের রহস্য উদঘাটনের যে কার্যকারণ-তত্ত্ব, সেটাকে ব্যাখ্যা করেন এরিস্টটলের অনুকূলে না থেকে। জগতের চিরস্থায়িত্বের ব্যাখ্যায় ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যের চেষ্টা করেন। খলিফা আল মুস্তাকিমের নামে তিনি লিখেন, প্রথমে পুরনো দিনের গ্রিক মনীষীরা যেসব দার্শনিক মতামত পেশ করেছেন, তা আমি লিখেছি। আমাদের আরব নীতি-নীতি অনুসারে নিজের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে যতটা পারি, যে কাজ তারা অসমাপ্ত রেখেছেন, তাকে আমি শেষ করতে চাই। ওয়ালজের-এর হিস্টোরি অব ফিলোসফি : ইস্টার্ন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কিন্দির এ ভাষ্য উল্লেখ করেন ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব।
এখানে যে বয়ান, তাতে স্পষ্ট, সবচেয়ে প্রভাবিত যাকে বলা হয়, সেই মুসলিম দার্শনিকও গ্রিক ঐতিহ্যকে নিজস্ব বিভূতি দিয়ে যাচাই করেছেন, এর আরব্য নবনির্মাণ চেয়েছেন, সাবেকরা যেখানে এসে থেমে গেছেন, তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার এবং পরিণতি দেবার সাধনা করেছেন। এটাই তো জ্ঞানের অগ্রসরতার ইতিহাস। এভাবেই তো এগিয়ে যায় সৃষ্টিশীলতা।
ইউরোপীয়রাও তো একই কাজ করেছেন। মুসলিমদের এই প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা ছিল বলেই তারা নব নব সৃষ্টিভাণ্ডার রেখে গেছেন। এই যে আল ফারাবির আল মদিনাতুল ফাদ্বিলাহ, কিভাবে একে প্লেটোর রিপাবলিকের অনুকরণ বলা সম্ভব? এটি গভীরভাবে আলাদা প্লেটো থেকে। এর কেন্দ্রীয় জোর ও সুর ইসলামের বিশ্বাস। মানুষ সম্পর্কে মৌলিক ধারণার জায়গা থেকে শুরু করে গুরুতর বহু জায়গায় ফারাবির অবস্থান গ্রিক দর্শন থেকে আলাদা। গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, মানুষ যে ভালোমন্দ বিচার করতে পারে, তা কেবল যুক্তি দিয়েই। মানুষ ছাড়া অন্য কেউ যুক্তিপ্রয়োগ করতে পারে না, অতএব ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না। ফলে মানুষ সবার সেরা। অন্য প্রাণী মানুষের অধম। ফারাবির মতে, শুধু যুক্তি-বুদ্ধি দিয়েই মানুষ সেরা হতে পারে না। বরং মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে আছে বিবেকগুণ। বিবেক না থাকলে যুক্তি পাশবপন্থা অবলম্বন করতেই পারে। যুক্তির ভালো-মন্দ যাচাই করবে জাগ্রত, সবল, স্বচ্ছ বিবেক। মৌলিক এ জায়গা থেকে ফারাবির ভিন্ন অবস্থান শাখাগত অসংখ্য ভিন্নতা নিশ্চিত করে। তিনি বরং অধিবিদ্যায় গ্রিক বিবেচনাসমূহকে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন একের পর এক।
ইবনে সিনার মৌলিকত্ব আরো স্পষ্ট। এভেসিনিজম, ইবনে সিনাবাদ তার মৌলিকত্বের ফসল। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভাদের অন্যতম হিসেবে তিনি স্বীকৃত। চিকিৎসাবিষয়ক তার কানুন গ্রন্থটি এতই মৌলিক যে, টমাস ক্লিফোর্ড বলেন, ইবনে সিনার কানুন হিপোক্র্যাটিস ও গ্যালেনের কৃতিত্বকে স্লান করে দিয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি পশ্চিমে ঞযব চৎরহপবংং ড়ভ চযুংরপরধহং নামে পরিচিতি লাভ করেন। আর কানুন গ্রন্থটি চিকিৎসা জগতে গবফরপধষ ইরনষব এর সম্মান পেয়েছে। দর্শনে অন্যদের মতবাদ-এর ভাষ্যের পরিবর্তে তিনি নিদর্শনকে বিকশিত করেন যাতে পুরনো মতবাদ নতুন রূপ লাভ করে। বিভিন্ন দর্শনের সমন্বয় সাধন হচ্ছে ইবনে সিনার দর্শন। এতে মৌলিকত্বের জায়গায় তিনি সচেতন ছিলেন বরাবরই। নিজস্ব দর্শনপদ্ধতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি জগতের জ্ঞাত দর্শনসমূহের ওপর আলোকপাত করেন। কিন্তু সঙ্গতিপূর্ণভাবে কোনো দর্শন অনুসরণ করেননি। গ্রিক দর্শনের অনুকারী হিসেবে তাকে আখ্যা দানের সুযোগ তিনি রাখেননি। ও’লিয়ারি তাকেই সমগ্র বিশ্বের সারসংক্ষেপ রচনাকারীদের অগ্রদূত বলে বর্ণনা করেন।
অনুরূপভাবে ইবনে রুশদ প্রবলভাবে এরিস্টটলের সমর্থক হয়েও স্বাধীন ব্যাখ্যা করেছেন। তার মৌলিকত্ব অসংশয়। যার উপর দাঁড়িয়ে যায় ইবনে রুশদবাদ। এ এমন এক মতবাদ, যা নিয়ে বিতর্কে শত শত দার্শনিক গ্রন্থ রচিত হয়।
এসব দার্শনিকের উল্লেখ করলাম, কারণ এরাই গ্রিকদের নিয়ে চর্চা করেছেন সবচে বেশি। এ জন্য ইলমে কালাম তাদেরকে আক্রমণ করেছে তুমুল। অন্য দার্শনিকরা তাদের চেয়ে কম গ্রিক প্রতিবেশে ছিলেন। আব্বাসী আমলের কয়েকটি অনুবাদের ওপর ভর করে মুসলিম দর্শনের মৌলিকত্বকে অস্বীকার করার মধ্যে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা কাজ করে। গ্রিকদের যত বই অনূদিত হয়ে মুসলিম দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে, এর চেয়ে বহুগুণ বেশি ইসলামী বই অনূদিত হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। পশ্চিমারা দশম শতক থেকে ষোড়শ শতক অবধি মুসলিমদের গ্রন্থাবলি অনুবাদ করে গেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ কাজ জারি রেখেছে তারা। মুসলিম দুনিয়ায় একবারই দেখা গেছে গ্রিক অনুবাদের উদ্যম। মাত্র একবার। কয়েক বছরের জন্য। আর মুসলিমরা গ্রিকদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। কিন্তু ইউরোপ মুসলিম রচনাবলি অনুবাদ করে চলেছে পাঁচ শতাব্দী ধরে। এই পুরো সময় তাদের জ্ঞানজগৎ বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রায় সব শাখায় মুসলিমদের রচিত গ্রন্থাবলির উপর নির্ভরশীল ছিল।
লেখক : কবি, গবেষক